আলামিন ভাইয়ের ডিজিটাল ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প

Add Your Heading Text Here

সারসংক্ষেপ :

চাঁদপুরের এক গ্রামের ছেলের গল্প এটি। ১৬ বছর বয়সে আলামিন বাড়ি ছেড়েছিলেন কাজের সন্ধানে । যে গ্রামে তার শৈশব কেটেছে, সে গ্রামে লাগেনি তখনো ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। খেটে খাওয়া ওসব মানুষের কাছে স্মার্ট ফোন বা অ্যাপের বিষয়টাও বেশ অলীক কল্পনা। এমন একটি জায়গা থেকেই উঠে এসেছিলেন আলামিন। কর্মজীবনের শুরুটা ঘড়ির দোকানের কর্মচারী হিসেবে শুরু হলেও, এখন নিজের ব্যবসায় আছে। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করেছেন। পরিবার আর ভাইদের সহায়তা করছেন। যে ব্যবসায় দিয়ে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গিয়েছে, সে ব্যবসায়ের হিসাব রাখার সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন টালিখাতা অ্যাপকে। সেই সাথে দোকানে লাগিয়েছেন সিসি টিভি ক্যামেরা। চাঁদপুরের গ্রামের ছেলেটির কিভাবে ডিজিটাল ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন সেই গল্প জানতে পড়ুন এ ব্লগটি।
 

মূল গল্প

 আলামিন ভাই চাঁদপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন ২০০৫ সালে। বয়স তখন ষোল। পরিবারের বড় ছেলে তাকেই অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। প্রথমে কিছুদিন কাজ করে একটি ঘড়ির দোকানে। তারপরে ৬ বছর আগে নিজে ব্যবসা। প্রথমে ছোট করে শুরু করলেও রাজধানীর ভাটারা এলাকায় এখন ব্যবসা মোটামুটি বড়। রাজধানীর ভাটারায় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তিন ভাই স্টোর। সব ধরনের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। পাঁচটা ফ্রিজ দোকানে। 

 

ব্যবসা ভালো চলছে। ধীরে ধীরে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে তার ব্যবসা। ব্যবসার উপার্জন থেকে থেকে গ্রামে বাড়ি করেছেন। ভাইদেরকে ঢাকা নিয়ে এসেছেন। দুই ভাই কে সহযোগিতা করছেন।

আগে খাতায় কিছু কিছু হিসাব রাখা সম্ভব হতো। অনেক বাকি কাস্টমার আছে বাকি নিয়ে থাকেন। বাকিগুলো কাগজে লিখে রাখতেন। ছোট ছোট বাকি যেমন ৫০ টাকা ১০০ টাকা হয়তো লিখে রাখতেন না। অনেক সময় বাকি লিখতে ভুলে যেতেন। অনেকগুলো কোথায় থাকতো, অনেক সময় ভুলে যেতেন। কজন বাকি নিল সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন হতো। কত টাকা বাকি সেটা তো আরও কঠিন।

এক বছর আগে তিনি টালিখাতা ব্যবসার অ্যাপের কথা জানতে পারেন। অ্যাপটি ডাউনলোড করেন এবং এরপর থেকে উনি নিয়মিত এই অ্যাপটি ব্যবহার করেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে  ব্যবসার সব ধরনের কেনা, বেচা, খরচ এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখছেন। কাস্টমাররা যখন বাকি নেয় তখন তিনি হিসাবটা টালিখাতায় লিখে রাখেন। সাথে সাথে কাস্টমার একটা এসএমএস পেয়ে যায়। বাকি নিয়ে কাস্টমারের সাথে গরমিল বা মনোমালিন্য হবার কোন ভয় থাকে না।

পুরনো বাকির খাতা খুঁজে খুঁজে উনি সকল বাকি কাস্টমারদের হিসাব টালিখাতায় নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে অনেক পুরনো কাস্টমার বাকি নিয়ে বাসা বদল করে ফেলেছেন, কাস্টমার হতে নিজেই ভুলে গেছেন কত বাকি ছিল, অথবা চলে গেছেন অন্য কোন শহরে। এখন টালিখাতা হিসাব দেখলে তার সব বাকি একসাথে দেখা যায়।

অ্যাপ এর মাধ্যমে উনি পুরনো কাস্টমারদের বাকির তাগাদা মেসেজ পাঠাতে পারেন। শুধুমাত্র তাগাদা মেসেজ পাঠিয়ে উনি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা পুরানো বাকি আদায় করেছেন। আসলে কাস্টমারদের অনেকেই বাকির টাকা ফেরত দিতে চান। অনেক সময় দেখা হয় না। মনে থাকে না। তাই দেয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাকিটা ফেরত দেয়া হয় না। টালিখাতা অ্যাপের তাগাদা মেসেজ বাকি আদায়ের কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে।

কখনো কখনো কাস্টমারের সাথে বাকির পরিমাণ নিয়ে আগে সমস্যা হতো। কেউ কেউ হয়তো বাকি নিয়ে ভুলে গেছেন। অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিল, তাই কত টাকা বাকি নিয়েছেন সেটা  মনে নেই। এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে দোকানদার বা কাস্টমার ভুলে গেলেও অ্যাপ অথবা এসএমএস তা ভুলবে না। ব্যবসায়ীর ফোন হারিয়ে গেলেও টালিখাতার হিসাব থেকে যাবে। সুতরাং ব্যবসায় ক্ষতি হবে না।

কোম্পানির কাছ থেকে কত টাকার মাল কেনা হলো, আর কত টাকা বিক্রি করা হলো, সে সম্পূর্ণ হিসাব টালিখাতায় দেখা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। খরচের হিসাব করা যাচ্ছে। কত টাকা লাভ হল সেটাও জানা যাচ্ছে। ব্যবসা পরিচালনা এখন অনেক সহজ হয়েছে। 

আলামিন ভাই প্রতিদিন কিছু টাকা আলাদা করে রাখেন তাঁর মাসের খরচ চালাবার জন্য। দোকান ভাড়া, লোনের কিস্তি আর বাসা ভাড়া পরিশোধের জন্য তাকে মাসে মাসে টাকা দিতে হয়। সেজন্য প্রতিদিন উপার্জন থেকে তিনি ৩০০ টাকা আলাদা করে রাখেন যাতে মাসের শেষে তাকে বাড়ির ভাড়া এবং লোনের কিস্তির জন্য ভাবতে না হয়।

ব্যবসার হিসাব রাখা এখন কত সহজ হয়ে গেছে। তাকে আর অনেকক্ষণ লাগিয়ে এই খাতায় খাতায় হিসাব খুঁজে যোগ-বিয়োগ করে হিসাব মিলাতে হয় না। আগে মাসের দশ তারিখ সব কাগজপত্র নিয়ে বসতেন মাসিক হিসাব মিলাতে। সব খাতা আর কাগজ একসাথে করে অনেকক্ষণ যোগ বিয়োগ করে মোটামুটি একটা বেচাকেনা আয়-ব্যয় খরচের হিসাব দাঁড় করাতেন। যেহেতু দশ তারিখে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় ১০ তারিখ থেকে ১০ তারিখে মাসের হিসাব করতেন। 

টালিখাতায় সব রাখার পর থেকে এখন তাকে আর মাসের শেষে এর হিসাব করতে হয়না। দিনের শেষে দিনের হিসাব পেয়ে যান। মাসের শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাসের হিসাব পেয়ে যান। ব্যবসার প্রতিটি লেনদেন এবং বিভিন্ন রকমের রিপোর্ট দেখতে পান। তাকে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করে গলদঘর্ম হতে হয় না। ব্যবসা পরিচালনার জন্য, ব্যবসার হিসাব রাখার জন্য, তাকে আর এখন বাড়তি শ্রম আর সময় দিতে হয় না, টেনশন নিতে হয় না। এখন তিনি ব্যবসার মূল বিষয়ে প্রোডাক্ট কেনা আর বেচার উপর এবং কাস্টমারদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের উপর বেশি সময় দিতে পারেন। চাহিদামত প্রোডাক্ট ভালো দামে কিনতে পারলে, বিক্রয় এবং উপার্জন বাড়ে।

আলামিন ভাই জীবনটাকে অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। ১৬ বছর বয়সে একা ঢাকা শহরে চলে এসেছেন। এখন ৩২ বছর বয়সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। এরমধ্যে গ্রামে চারতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি বাড়ি করেছেন। বিয়ে করেছেন এবং তার ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। উনি এখন ভাবেন ধীরে ধীরে কিভাবে ব্যবসা বাড়ানো যায়, কিভাবে আয়-উন্নতি বাড়ানো যায়, কিভাবে পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারবেন।

আল আমিন ভাই শুধুমাত্র টালিখাতা নয়, তারা দোকানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। অনেক সময় গ্রাহকরা আসলেন, বাকি নিয়ে চলে গেলেনন। হয়তো ভুলেই গেলেন বাকি নিয়েছেন অথবা বলছেন বাকি নেন নাই। আলামিন ভাই চাইলে তার টালিখাতা হিসেব দেখিয়ে দিয়ে প্রমাণ করতে পারেন, প্রয়োজনে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখিয়ে ওই সময়ের লেনদেন দেখাতে পারেন যে উনি নিজেই এসেছিলেন। এভাবেই প্রযুক্তি আমাদের জীবনের সব জায়গায় কেমন সহযোগিতা করে এবং ছড়িয়ে যায়। ওই দোকানের লোকেশন সহ যেমন হিসাব রাখা যায়, প্রতিটি লেনদেনের সময় জানা যায়, আর তার মাধ্যমে আরও অন্যান্য বিষয় যেমন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খুঁজে বের করা অনেক সহজ হয়। এইতো ডিজিটাল বাংলাদেশে। ডিজিটাল যেকোনো জিনিস ম্যানেজ করা সহজ হয়, কাজের দক্ষতা বাড়ে, উপার্জন বাড়ানো যায়। আলামিন ভাই বলেন, টালিখাতা ব্যবহার শুরুর পর থেকে এখন এই অ্যাপেই তার ব্যবসা চলে, ব্যবসা এখন তার হাতের মুঠোয়।

আলামিন  ভাই একা নন বাংলাদেশ ২৫ লাখেরও বেশি ব্যবসায়ী টালিখাতা হিসাব রেখে নিয়মিত ব্যবসা চালাচ্ছেন। আল আমিন ভাই বলছিলেন তাকে দেখে, তার সাহায্যে, তার টালিখাতা ব্যবহারে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতিমধ্যে অনেকে ভাটারা এলাকায় এবং চাঁদপুর এলাকায় টালিখাতা ব্যবহার করছেন। তিনি ডিজিটাল সিস্টেম কিভাবে ব্যবহার করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেন এবং অনুপ্রেরণা দেন। তিনি যদি টালিখাতা ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন, তাহলে অন্যরাও সেটা পারবে এবং তারা যদি নিয়মিত হিসাব রাখে তাদের ব্যবসা চালানোর সহজ হবে, ব্যবসা হিসাবে তাদের চোখের সামনে থাকবে এবং তাদের এই হিসাব ব্যবহার করে তারা যদি সুষ্ঠু হবে ব্যবসা পরিচালনা করেন, তাহলে ভবিষ্যতে আল আমিন ভাইয়ের মতো হয়তো ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সহযোগিতা পেতে পারেন। ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য এখন অনেক সুযোগ আছে কিন্তু আমরা সুযোগের কথা জানিনা। টালিখাতার মত একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদেরকে সেই সুযোগের কথা জানাতে পারেটালিখাতা  এর মাধ্যমে সারাদেশে ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসা করার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য যেমন দেয়া যায়, বাজার সম্পর্কে তথ্য দেয়া যায়, ব্যাংকের প্রডাক্ট সম্পর্কে তথ্য দেয়া যায়, তাদের ব্যবসার হিসাব রাখার বিষয়ে অনুপ্রাণিত করা যায়। তারা হয়তো একসময় আগের বাপ-দাদার কাছ থেকে কিভাবে ব্যবসা দেখেছে, সেই পদ্ধতিতে না করে ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্যবসা করতে পারে, যাতে ব্যবসা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা হয়, কষ্ট করে যোগ বিয়োগ করতে হয়না এবং পরিষ্কার ঝকঝকে হিসাব চোখের সামনে থাকে।

আলামিন ভাই মনে করেন উনি যেমন টালিখাতা সম্পর্কে জেনেছেন এবং ব্যবহার করে উপকার পাচ্ছেন, উনি মনে করেন যে উনি পারলে বাংলাদেশের আরো ৫০ লাখ ব্যবসায়ী এটা পারবে। তাদেরকে তাদের কাছেই মেসেজটা পৌঁছাতে হবে এবং যদি ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে সহযোগিতা করে তাহলে এইরকম একটা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শুধু নিজের ব্যবসা নয় তার সাথে সম্পর্কিত অন্য যারা ব্যবসায়ী আছে, সাপ্লাইয়ের আছে এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা আছে তারাও এই ব্যবসা থেকে উন্নতি হবে। যদি ৫০ লাখ দোকানদার ব্যবসায়ীরা এগিয়ে যায়, তাহলে তাদের সাথে কাজ করা আরও প্রায় এক লাখ পাইকারি ব্যবসায়ী, ডিলার এবং ডিস্ট্রিবিউটর এগিয়ে যাবে। মোটের উপরে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

আলামিন  ভাই, আপনি এগিয়ে যান আপনার ব্যবসা নিয়ে। এগিয়ে যাক যাক বাংলাদেশের এক কোটি দশ লাখ ছোট ব্যবসায়ীরা। জয় হোক ডিজিটাল বাংলাদেশের সকল ছোট ব্যবসায়ীদের।

মন্তব্য করুন